জেনারেটর মিস্ত্রি সুলতান তালুকদার। নামের মতোই রাতারাতি ‘সুলতান’ হওয়ার স্বপ্ন বুনছিলেন। ভেবেছিলেন, এবার লোহালক্কড়ের ‘কালো জগৎ’ ভুলে হবেন বড় শিল্পোদ্যোক্তা। সেই পথ ধরে হাঁটছিলেনও বেশ। কারণ রাতের আঁধার কেটে দিনের আলো ফুটলেই তাঁর অ্যাকাউন্টে বাড়ত ডলারের অঙ্ক। সপ্তাহখানেক আগেও বগুড়ার শাপলা মার্কেটের এই জেনারেটর মিস্ত্রির মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জের (এমটিএফই) অ্যাকাউন্টে ছিল হাজার হাজার ডলার। সহসা ‘বড়লোক’ হচ্ছেন ভেবে তিন মাস মিস্ত্রির কাজে দেন ইস্তফা। এখন সব হারিয়ে সুলতান হয়েছেন ‘ফকির’। আকাশ থেকে পড়েছেন গাড্ডায়। ফিরেছেন আগের পেশায়।
গতকাল সোমবার দুপুরে নিজ দোকানের সামনেই পাওয়া গেল সুলতানকে। রাজ্যের নিরাশা তাঁর মুখাবয়বে। জানালেন, চার মাস আগে জমানো দেড় লাখ টাকা এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেন। পাশের দোকানের ব্যবসায়ী রাজীব মণ্ডলের মাধ্যমে সিইও রাম মোহন দাসের মাধ্যমে তিনি এমটিএফইর খোঁজ পান। বিনিয়োগের জন্য তাঁকে খুলে দেওয়া হয় একটি অ্যাকাউন্ট। সেখানে টাকা রেখে প্রতি সপ্তাহে ৩০ হাজার টাকা লাভ যোগ হতে থাকে ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্টে। এত লাভ দেখে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। এক সপ্তাহ পরে স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও আত্মীয়স্বজনের নামে আরও ১০টি অ্যাকাউন্ট খোলেন তিনি। নিজে স্বল্পশিক্ষিত হওয়ায় পাশের এক ব্যবসায়ী বন্ধু তাঁকে হিসাব বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর জমানো ২০ হাজার ডলারের মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার টাকা তুলতে পেরেছিলেন। বাকি টাকা অ্যাকাউন্টসহ হাওয়া।
অনলাইনে ক্যাপচা এন্ট্রি করে আয় করুন, সেরা ১০টি জব সাইট
শাপলা মার্কেটের ৫০ জনের বেশি ব্যবসায়ীর খোঁজ মিলেছে, যারা এমটিএফইর সঙ্গে ছিলেন। শহরের বিভিন্ন বাজারের ব্যবসায়ী, দোকান কর্মচারী, গৃহিণী রাতারাতি ‘বড়লোক’ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। তারা সবাই এখন নীরবে কাঁদছেন। অনেকেই বলছেন, মাত্র ২০০ ডলার বিনিয়োগ করলে দিনশেষে ৫ হাজার টাকা লাভ হবে– এমন সুযোগ কে ছাড়তে চায়! তাই সোনার গহনা ও মূল্যবান সামগ্রী বন্ধক রেখেও বিনিয়োগ করেছিলেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাপলা মার্কেটের রাজীব মণ্ডল, পাপ্পু জিলাদারসহ অন্তত ৫০ জন, শহরের রাজাবাজার ও নিউমার্কেটের ২ শতাধিক ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারী এই অনলাইন মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছিলেন। এদের সবার সিইও ছিলেন রাম মোহন দাস। রাম মোহনের মতো বগুড়া শহরে অন্তত ২০ জন সিইও ছিলেন। সব হারানো আরেক ব্যবসায়ী আমিনুল হক বলেন, শনি ও রোববার বাদে সপ্তাহের অন্য ৫ দিন এই অ্যাপসে ট্রেডিং হতো। সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকার ডলার অ্যাকাউন্টে ঢুকালে সপ্তাহে ৫ দিনের প্রতিদিন ৫ হাজার টাকার সমমান ডলার লাভ দেওয়া হতো। অ্যাপসে ঢুকে শুধু একটি জায়গায় ক্লিক করতে হতো। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের আর তেমন কোনো কাজ ছিল না। এ জন্য অশিক্ষিত লোকও সহজে এই ব্যবসা করতে পারতেন।
ব্যবসায়ী আবুল কাশেম বলেন, ‘সব শেষ হয়ে গেল। এখন আর কিছু পাওয়ার আশা নেই। বিনিয়োগ শুরুর পর প্রথম সপ্তাহে দিনপ্রতি ৫ হাজার করে আয় করেছিলাম। সেখান থেকে কিছু টাকা উঠিয়েও নিই। পরে কোম্পানি থেকে লোভ দেওয়া হয় ডলার জমা রাখতে। এভাবে চার মাসে আর ডলার উঠাইনি। সর্বশেষ ১৭০০ ডলারের মতো জমা রেখেছিলাম। যত বেশি ডলার তত লাভ। এই করতে গিয়ে সব হারালাম। আমি নিজের ছাড়াও আমার ছোট শিশুর জমানো টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম।’
পাপ্পু জিলাদার সবার দেখাদেখি মাসখানেক আগে ৫০ হাজার টাকার মতো বিনিয়োগ করেছিলেন। সব টাকা এখন ‘ছাই’। তিনি বলেন, ‘এই টাকা দিয়ে অন্য ব্যবসা করতে পারতাম। লোভ করেছি, তাই শাস্তি পেয়েছি।’ ব্যবসায়ী রাজীব মণ্ডল বলেন, ‘সিইও রাম মোহন আমার পরিচিত। তাঁকে চিনে আমি ২৫ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। পুরো টাকা মাটিতে মিশে গেছে।’
জানা গেছে, বগুড়ায় এর আগে ডেসটিনি ও পিএলসির মতো এমএলএম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িতদের টার্গেট করে এমটিএফই। তাদের নানারকম চটকদার প্রস্তাবনা দিয়ে মাঠে নামানো হয়। সবাইকে প্রথম অবস্থায় শতাধিক স্থানীয় প্রতিনিধির বিনিয়োগ সংগ্রহ করতে দেওয়া হয়। এর পরই দেওয়া হতো সিইও পদমর্যাদা। প্রত্যেক সিইওকে বগুড়া শহরে অফিস নেওয়ার জন্য প্রথমেই দেড় লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয় এমটিএফই। এ ছাড়া প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার সিইওদের নিজ নিজ স্থানীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে শহরের অভিজাত সব রেস্তোরাঁয় সভা-সেমিনারের আয়োজন করার জন্য টাকা দেওয়া হতো। সেখানে থাকত বাহারি সব খাবারের আয়োজন। এসব সেমিনারে এমটিএফইতে ক্রিপ্টোক্যারেন্সির মাধ্যমে বিনিয়োগের নানা পদ্ধতি শেখানো হতো। স্থানীয় প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করা হতো এই প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সব নিরাপত্তার খাত নিয়ে। এ জন্য মাঠে খেলা চলাকালে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারের গায়ে থাকা জার্সি ও বিশ্বকাপের ফুটবলে এমটিএফইর নিখুঁত এডিট করা লোগো সভায় উপস্থিত বিনিয়োগকারীদের দেখানো হতো। এসব দেখেই বিনিয়োগকারীরা সহজেই বিশ্বাস করতেন এমটিএফই একটি আন্তর্জাতিক মানের আর্থিক প্রতিষ্ঠান। নওগাঁ ও জয়পুরহাটে প্রতারণার শিকার হাজারো মানুষ ব্যবসায়ী মিনার হোসেন জানান, কেউ জমি বন্ধক রেখে, কেউবা জমানো টাকা, আবার কেউ বিভিন্ন এনজিও থেকে ধারদেনা করে লাখ লাখ টাকা এমটিএফইর অ্যাকাউন্টে বিনিয়োগ করেছিলেন। পুরো জেলায় ১০ থেকে ১২ জন এমটিএফই অ্যাপের সিইও হিসেবে কাজ করতেন। কাউকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিলে কোম্পানি থেকে তাদের কমিশন দেওয়া হতো। তবে হঠাৎ করে অ্যাকাউন্ট থেকে তারা আর টাকা ওঠাতে পারছিলেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নওগাঁ শহরের এক ভুক্তভোগী জানান, একটু লাভের আশায় ধার করে ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। কিছু দিন তারা ওই টাকার ওপর লাভও দিয়েছিল। হঠাৎ কিছু দিন আগে থেকে অ্যাপটি থেকে টাকা ওঠানো বন্ধ হয়ে যায়। সব ডলার কেটে নিয়ে উল্টো অ্যাকাউন্টে বিশাল অঙ্কের ‘মাইনাস’ ডলার দেখাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা পরিশোধও করতে বলেছে। ২৪ ঘণ্টা পর আজ আবার তাদের অ্যাপে নোটিশ দিয়েছে, ‘২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে আপনি ঋণ পরিশোধ করেননি। আপনাকে আরও ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়া হলো, এর মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করলে আপনাকে আইনি নোটিশ পাঠানো হবে।’
নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের ভুক্তভোগী শৈনান্দ্র নাথ বলেন, ‘একজন এসে বলল এমটিএফইতে বিনিয়োগ করলে নাকি টাকা আয় করা যাবে। পরে একটি এনজিও থেকে ৬০ হাজার টাকা তুলে সেখানে বিনিয়োগ করি। এখন ওই অ্যাপসে আর ঢোকা যাচ্ছে না। টাকাগুলো না পেলে এনজিওর টাকা পরিশোধ করব কীভাবে?’ জয়পুরহাটে প্রতিদিন মোটা অঙ্কের লভ্যাংশে প্রলুব্ধ করে তাদের কাছ থেকে ১০ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাতজন সিইও। তারা হলেন– সাদ আলম চৌধুরী, তামান্না আক্তার সুরভি, সুমন খন্দকার, মইনুল হোসেন, মোশারফ হোসেন, আল হোসেন রাব্বি ও শহিদুল আলম চৌধুরী। জেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকার প্রতারিতদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। একাধিক সদস্য জানান, আট মাসে উত্তরবঙ্গেই ২০টির বেশি অফিস তৈরি করা হয়। সেগুলো এখন বন্ধ।
বগুড়ার সুলতান এখন পথের ফকির – এমটিএফইর ভেলকি