Thursday , May 9 2024

অপয়া

আমি যখন জন্মেছিলাম , তখন না কি সবার মুখ অন্ধকার । ”ইশ ,শেষে কি না মেয়ে !কোনো মানে হয় !.”.
বাবার তো ব্যবসা, কে দেখবে! মেয়েমানুষ কি আর হিসাব পত্তর বোঝে ! জন্মানোর পরই বাড়ির লোক একটা উপাধি দিয়ে দিল আমাকে, ‘ অপয়া মেয়ে’, জন্মেই মা’টাকে খেল ।
ছোটবেলায় যখন পুজোর কাজে আমাকে নেওয়া হত না, বাড়ির কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান থেকে আমাকে দূরে রাখা হত এই বলে যে তুই ‘অপয়া’ তখন বার বার একটা প্রশ্নই মাথায় ঘুরত, ‘অপয়া মানে কি ? কি দোষ করলে এটা হয় ?’..
আমার স্কুল, পড়াশোনা নিয়ে কখনই বিশেষ কারোর মাথা ব্যথা ছিল না । বাবা আমার থেকে একটু দূরে দূরেই থাকত সব সময়। আমি তো মা’কে খেয়েছি । তাই, আরো একটা কারণ ছিল, আমার বাবার দ্বিতীয় বউ, আর তার ছেলে ‘শুভ’ । বাবা নিজের নতুন সংসারে সব সময় মেতে থাকত ।পুরনো অশুভ জিনিস নিয়ে বাবার খুব একটা মাথা ব্যথা থাকার কথাও না ।
মাধ্যমিকের সময় অঙ্ক নিয়ে আমার একটু ভয় লাগত । সেই একবারই বাবার কাছে একটা কিছু চেয়েছিলাম, ” বাবা, আমাকে শুভর অঙ্কের স্যারের কাছে ভর্তি করে দেবে ? আমার খুব help হবে । ”
” কোনো দরকার নেই, কত তো বিদ্যাসাগর হবি জানা আছে । আমার কাছে টাকা নষ্ট করার মতন টাকা নেই । ওর মাইনে কত জানিস ! ৫০০ টাকা।” উত্তরটা শুনে সেই দিন হঠাৎ নিজের মূল্যটা বুঝলাম । সত্যিই তো, ৫০০ টাকা খরচা করার মতন দামী না কি আমি ! সেই দিন চোখটা জলে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল । তারপর আর কখনো বাবার কাছে কিছু চাইনি ।
আর্টস নিয়েই পড়াশোনাটা করলাম । কলেজ শেষে ইউনিভার্সিটি তে পড়ব যখন বাড়িতে বললাম তখন বাড়ির প্রত্যেকের চোখ বড় বড়, আমার সৎ মা বলেই ফেলল, “যত সব ন্যাকামি ।পারি না ।” আর বাবার উত্তরও জানা, ”টাকা নষ্ট করার মতন টাকা নেই ।…” .. সেই দিন আমিও প্রত্যুত্তরে একটা কথা বললাম , ” আমারও সেই টাকার দরকার নেই ।”.. যেই মাকে চোখে দেখিনি, তার একটা সোনার চেন, আর কানের দুল ছিল ।বিক্রি করে দিলাম । যে আমাকে ৯ মাস পেটে রেখে নিজের জীবন দিয়ে জন্ম দিল, তার কাছে নিশ্চয় আমি দামী ছিলাম । তাই তার টাকা আমার জন্য নষ্ট হবে না ।
ইউনিভার্সিটি তে পড়ার দৌলতে শুরু হলো আমার হোস্টেল লাইফ। এমন একটা লাইফ যেখানে কথায় কথায় কেউ আমাকে ‘অপয়া’ বলে না, এমন একটা লাইফ যেখানে অনেক ছেলে বন্ধু আমার লেখা নোটস চেয়ে নিয়ে গিয়ে মুখস্ত করে পরীক্ষায় লেখে , এমন একটা লাইফ যেখানে ইউনিভার্সিটি তে highest marks পাওয়ার জন্য স্টেজে ডেকে উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়।
এই সবের পর আর বাড়ি ফেরা হয়নি। স্কলারশিপের টাকাতে পি.এইচ.ডি টা শেষ করেই কলেজে চাকরি । মাইনের টাকায় নিজের একটা আলাদা ফ্ল্যাট আর নিজের শর্তে বাঁচার মতন স্বাধীনতা, দুটোই ভালো মতনই হয় ।এই ভাবেই দিন কাটছিল । কিন্তু হঠাৎ একদিন মাঝরাতে ফ্ল্যাটের দরজায় ধাক্কা, দরজা খুলে দেখলাম শুভ ” দিদি, খুব বিপদে পরে তোর কাছে এসেছি । ব্যবসায় অনেক টাকা লোকসান হয়ে গেছে রে । আমাকে ৪০,০০০ টাকা দিতে পারবি রে । নইলে আর ব্যবসাটাকে বাঁচাতে পারব না।”
প্রায় ৮ বছর বাদে সেই দিন বাড়িতে ঢুকলাম । আজ আর কেউ আমাকে ‘অপয়া’ বলছে না । আজ আমি ‘পয়া’ । এই সংসার,এই ব্যবসা বাঁচিয়েছি তো, তাই আজ আমি ‘লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে..’ । বাবার আমাকে দেখে এক গাল হাসি । আমার সৎ মা আজ আমার জন্য নিজের হাতে পায়েস বানিয়েছে। কি আদর যত্ন আপ্যায়ন । সেই দিন আমি একটা চাবি পেলাম, বাবা-ই নিজের হাতে দিল ।আমার মরা মা’র আলমারির চাবি।সেই আলমারির সব শাড়ি আজ আমার ।
আলমারি খুলে যেন আমি মা’কে পেলাম ।যেই মা’কে কখনো দেখিনি তার গন্ধ পেলাম । যেন মা’র হাতের একটা ছোঁয়া পেলাম ।কিন্তু হঠাৎ একটা শাড়ির ভাঁজে রাখা একটা ডায়রি দেখলাম,তার ভেতরে রাখা একটা ডাক্তারি রিপোর্ট ,… সেটাতে লেখা অ্যানিমিয়ার পেসেন্ট , রক্ত শরীরে খুব কম , বাচ্চা নিলে কখনো সারভাইব করতে পারবে না , আর তার পাশে ডায়েরির পাতায় লেখা শুধু দুটো শব্দ …
” মৃত্যু নিশ্চিত ” । ওটা আমার মরা মা’র হাতের লেখা ।
সেই দিন বুঝলাম মা মারা যায়নি , মাকে খুন করা হযেছিল। শুধু একটা লোভে, ” ছেলে পাওয়ার লোভে ।

About admin

Check Also

ফুলের ব্যাপারে আমার বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই

ফুলের ব্যাপারে আমার বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। তবে মেয়েরা যে ফুল ভালোবাসে, এই ব্যাপারটা আমার …