জীবনে প্রথম সরাসরি তেল দিয়েছিলাম আমাদের হেডস্যারকে।
টিফিন পালিয়ে আমরা তাস পেটাতে যেতাম নিয়মিত; বিষয়টা শত্রুপক্ষীয় সহপাঠী ফাঁস করে দিলে নিয়মানুযায়ী হেডস্যারের রুমে আমাদের ডাকা হলো। বইপত্র সব জমা পড়ে আছে তার টেবিলে। আমার বই বলতে একটা লম্বা খাতা, তার ওপর সেবা প্রকাশনীর মারিও পুজোর গডফাদার। বইটার প্রচ্ছদসহ প্রথম দিকের কয়েকটা পাতা উড়ে গেছে। যে পাতাটা সামনে বেরিয়ে আছে, সেটায় চলছে লুসির সঙ্গে রগরগে ঘটনা। হেডস্যার সেটা পড়ে ফেলেছেন কিনা কে জানে! হেডস্যারের গুরুগম্ভীর কণ্ঠ, ‘তোমাদের কাছে তো আর কিছু শুনব না। স্কুল পলাতক ছেলেপিলে আমার কেউ হয় না। কালকে তোমাদের অভিভাবকদের ডাকা হবে। তাদের সাথে আমাদের মিটিং হবে। তারপর আমরা তোমাদের টিসি দিয়ে বলব—খোদা হাফেজ!’
ক্লাস নাইনে পড়ি তখন। এসব কথা শুনলে বুক ধড়াস করে ওঠে। হিমেলের মুখটা হলো কাঁদো কাঁদো। আমার হঠাৎ এমন বাথরুম চাপল যে স্যারের অ্যাটাচড বাথরুমটার দিকে ঘন ঘন তাকাতে লাগলাম। রিটু ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভোলাভালা। সে বলল, ‘ঠিক আছে, স্যার। আমরা তাহলে কালকে আব্বাদের ডেকে নিয়ে আসব।’
মনে হলো, রিটুর জিবটা ধরে চেয়ারের সঙ্গে পেরেক মেরে দিই। মনোজ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আসলে স্যার, আমরা তো বার্ষিক ফুটবল ম্যাচের জন্য আমাদের পুরানা গোলকিপারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম…।’
‘তাই নাকি? তা কার অনুমতি নিয়ে গিয়েছিলে?’
যা থাকে কপালে ভেবে গেমস্যারের নাম নিয়ে নিলাম। বিপদে মানুষ খড়কুটোতে ভরসা রাখে, আমরা রাখলাম গেমস্যারের ওপর। তিনি খড়কুটো নন, আমাদের মোটামুটি ভালোবাসেন। কিন্তু হেডস্যার আজকে নাছোড়। বললেন, ‘ঠিক আছে। উনি তো এখন ক্লাসে। আগে আসুক, তারপর শুনব।’
রুমময় নীরবতা। নীরবতা সব সময় হীরণ্ময় যে নয়, সেদিনই প্রথম টের পেলাম। কেমন যে অস্বস্তি! এরই মধ্যে হিমেল ফিসফিসিয়ে বলল, ‘একটু বাথরুম করে আসা যাবে রে?’
যাক! সমস্যা শুধু আমার না!
না তো, স্যার। বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম, আপনি বেত নিয়ে বারান্দায় ঘুরছেন। আমরা তখন আপনার…ভয়ে…স্যার…ভয়ে স্যার…আসলে আসতে পারিনি। আপনারই ভয়ে…।
মনোজের উসখুস চূড়ান্ত। বাড়ি পর্যন্ত খবরটা গেলে তার চামড়া খুলে স্যান্ডেল বানানো হবে, এ ব্যাপারে সে যথেষ্ট সচেতন। বলে উঠল, ‘স্যার, আমরা কিন্তু চলেই আসছিলাম…।’
‘তাই নাকি? তা কিসে আটকাল আসতে? গরু না ঘোড়া? নাকি জুজু ধরে নিয়ে চলে গিয়েছিল?’
মনোজ নিরুত্তর। এতদূর পর্যন্ত ব্যাপারটা এনে এরকম বেমক্কা জায়গায় শেষ হয়ে যাবে, বুঝতে পারেনি। ঠিক তখনই আমি আমার জীবনের প্রথম তেলের ঘটনাটা ঘটালাম।
বললাম, ‘স্যার, চলেই এসেছিলাম, স্যার। মানে একেবারে গেটে। কিন্তু টিফিন পিরিয়ড তখন কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেছে তো, তাই…।’
‘তাই ঘুরে আবার চলে গেছো?’
‘না তো, স্যার। বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম, আপনি বেত নিয়ে বারান্দায় ঘুরছেন। আমরা তখন আপনার…ভয়ে…স্যার…ভয়ে স্যার…আসলে আসতে পারিনি। আপনারই ভয়ে…।’
কথাটা শুনেই হেডস্যারের মুখটা কেমন নরম হয়ে এল। নাইনের বখাটেগুলো তাকে ভয় পায়, ব্যাপারটা বেশ সুখেরই মনে হলো তার জন্য। বললেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা, বই নিয়ে যা। আর যেন না হয় এইসব। আর, আমাকে ভয় পাওয়ার কী আছে রে, অ্যাঁ? আমি বাঘ না ভালুক?’
সেদিন জানলাম, তেলে কাজ হয়।
এরপর নিয়মিত তেল দিয়ে গেছি। বাঙালির ইতিহাস আসলে তেলের ইতিহাস। আমাদের সব জায়গায় তেল দিতে হয়। বন্ধুকে তেল, বান্ধবীকে তেল, ভাইকে তেল, বোনকে তেল। কাজের সময় এই তেলই হয়ে ওঠে আমাদের প্রধান প্রভাবক। আমার সারা জীবনের প্রেম দাঁড়িয়েছিল তেলের ওপর। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনাদের জীবনের প্রেমও আসলে দাঁড়িয়ে/বসে/শুয়ে আছে তেলের ওপরেই। এই যে আপনারা ‘বাবু খাইছো কি খাওনি’ বলেন, এটা যতটা জিজ্ঞাসা, তারচেয়ে অনেক বেশি তেল। এই তেল আবার দাম্পত্য জীবনে ফিরে আসে অন্যরূপে। তখন ‘বাবু খাইছো’ হয়তো বলেন না; কিন্তু বলেন, ‘বাহ্! আজকে তো তোমাকে অন্য রকম লাগছে। বয়স কমিয়ে তো ফেলেছোই, ওজনটাও কমালে নাকি?’
তেলের এই সর্বত্র ব্যবহারের সময় তেলের দাম আকাশচুম্বী হলো। প্রথমে শুনেই ভড়কে গিয়েছিলাম। কী করে বাঁচব রে—এমন একটা ফিলিংস এল ভেতরে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, আসলে কইয়ের তেলে যেমন কই ভাজতে হয়, ঠিক সেভাবেই তেল দিয়ে তেলের দামকে প্রতিরোধ করতে হবে। কীভাবে, সে উপায় বাতলে দিচ্ছি।
প্রথমেই ঠিক করে নিন জ্বালানি তেল আপনার কী কাজে লাগে। গাড়ি আছে আপনার, বাইক আছে? ঠিক আছে। গাড়ি–বাইককে ছুটি দিন। বহুত তো চড়লেন। এবার নিজের তেল কমান। অর্থাৎ চর্বি কমান। হাঁটেন। আপনার স্কুল-কলেজ বা কর্মস্থল যেটাই হোক না কেন, তাকে ভাবুন বনলতা সেন। জীবনানন্দ দাশের মতো মানুষ যদি হাজার বছর ধরে হাঁটতে পারেন, আপনি কেন পারবেন না? মনে রাখবেন, গায়ক এমনি এমনি গাননি ‘হাওয়ার ওপর চলে গাড়ি, লাগে না পেট্রোল–ডিজেল, মানুষ একটা দুই চাক্কার সাইকেল’!
তবে এমনও তো হতে পারে, প্রতিদিনের হাঁটাহাঁটি আপনাকে বিরক্ত করে তুলছে, বা আপনাকে একটু দূরতম জায়গায় যেতে হবে। ঠিক আছে, আপনার প্রতিবেশীর/কলিগের গাড়ি আছে, মোটরবাইক আছে? প্রতিবেশীকে একটু তেল দিন। তেল দেওয়া একটা শিল্প। এর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ গবেষণার প্রয়োজন হয়। আপনাকে জানতে হবে, আপনার প্রতিবেশী/কলিগ ঠিক কিসে খুশি হয়। তবে এ–ও ঠিক, দুনিয়ার সব মানুষই খুশি হয় প্রশংসায়। তাকে বলুন, আপনার মন কাচ্চির আলুর মতো। কিন্তু আপনার ব্যক্তিত্ব হলো খাসির হাড়ের মতো ড্যাশিং। অথবা তাকে বলুন, দুনিয়াতে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই, যাকে জয়া আহসানের পাশে মানায়। ধারাবাহিক এত তেলে দেখবেন আপনার জীবনে জ্বালানি তেলের অসুবিধা কমিয়ে নিয়ে আসবে। আপনি লিফট পাবেন। অন্যের গাড়িতে অন্যের তেলে আপনি করবেন এক নিরাপদ ভ্রমণ।
এ ছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি আপনার আর যা সমস্যা করতে পারে তা আকাশ-নদী-ফুল-ফল আর পাখি। আবার বলছি আকাশ-নদী-ফুল-ফল আর পাখি। এবং আবারও বলছি আকাশ-নদী-ফুল-ফল আর পাখি।
ফলে তেল দিয়ে তেলের সংকট কাটাতে হবে; শুধু নিজের নাকে না, তেলা মাথায় তেল দেওয়ার প্র্যাকটিস গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই দেখবেন, আর কোনো সংকট নেই। দেখবেন লাইফ ইজ তেলফুল!