অভিনেতা থেকে পরিচালক হিসেবে স্নাতক অতীতে অনেকেই হয়েছেন। তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে ছোটপর্দার তারকা তথাগত মুখোপাধ্যায় (Tathagata Mukherjee) বড়পর্দায় প্রথম ছবি ‘ভটভটি’তেই (Bhotbhoti) যে দুঃসাহস এবং সিনেমার ব্যাকরণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ঝুঁকি নিলেন, সেটা ছোট বুকের পাটায় হয় না। ছবির শুরু থেকেই বাস্তব, কল্পনা, অতিবাস্তব, পরাবাস্তব, জাদুবাস্তব সবকিছু মিলিয়ে দর্শককে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করিয়ে দেন তথাগত।
কলকাতার গঙ্গাপাড়ের এক জাহাজবস্তির অতিসাধারণ তরুণ ভটভটি গঙ্গায় ডুব দিয়ে ‘এরিয়েল’ নামে এক জলপরির দেখা পায়। সেটা তার স্বপ্ন নাকি কল্পনা! বিষয়টি বুঝে ওঠার আগেই এসে পড়ে কোনও এক গ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিচ্ছে একদল তরুণ-তরুণী। তাদের মধ্যে থেকেই এক তরুণী ‘এরিয়েল’ হয়ে এসে পড়ে ভটভটির কাছে। সে বিশ্বাসও করে দেহাতি মেয়েটি তার স্বপ্নের জলপরী।
এদিকে শহরে ঢুকে পড়েছে সেই বিপ্লবীর দল। অনির্বাণ চক্রবর্তী এমন একটি অদ্ভূত চরিত্র করছেন, যার কাজ রুমালের মতো কাপড়ে ভারী কিছু জড়িয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে শত্রুপক্ষের কাউকে এক আঘাতেই খতম করা। একটি সংলাপও তাঁর মুখে নেই। সে কি বিপ্লবী দলের? নাকি শুধুই এক খুনি? স্পষ্ট নয়। আরও অনেক কিছুই অস্পষ্ট পৌনে তিন ঘণ্টার এই ছবিতে। ভটভটি আর জলপরী শহর ছেড়ে পাহাড়, নদী, জঙ্গল কোথায় না ঘুরেছে, কিন্তু কেন? তার উত্তর এক জটিল ধাঁধা। অথচ পুরো ছবি জুড়ে পরিচালক ক্যামেরার মাধ্যমে অসম্ভব সুন্দর ভিজুয়্যালস রেখেছেন। সম্পাদনার কাজও বেশ চিন্তার খোরাক দিয়েছেন দর্শকের। কিন্তু সেই চিন্তা যে কোন খাতে বইছে তার খেই ধরাই এক সমস্যা।
ছবির শেষ পর্বে এক দম্পতি দীপংকর দে ও মমতা শংকর ভটভটি ও এরিয়েলকে বাঁচাতে পুলিশের সঙ্গে যে ব্যবহার করলেন সেটাই বা কেন? এখানে নকশাল আন্দোলনের একটা ইঙ্গিত দেওয়া হল বটে, তবে পুরো ছবির সঙ্গে তার কতটুকু যোগ রয়েছে পরিচালক নিজে বুঝতে পেরেছেন কি? আসলে বাস্তব-পরাবাস্তব এবং জাদুবাস্তব নিয়ে সিনেমা বানানো খুব সহজ কাজ নয়। হ্যাঁ, তথাগত নিশ্চয়ই দুর্দান্ত, অসাধারণ কিছু শট নিয়েছেন, দেখতেও ভাল লেগেছে, কিন্তু এত সব সুন্দর জিনিস নিয়েও সুন্দর একটা সিনেমা হল না। সিনেমা ব্যাকরণ নিয়ে কাজ না করার অভিজ্ঞতার কারণে।
তবে এই ছবি জানিয়ে দিল তথাগত একজন ব্যতিক্রমী পরিচালক হওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এই ছবি থেকে বড় প্রাপ্তি হল বিবৃতি চট্টোপাধ্যায় (Bibriti Chatterjee) নামে আয়ত আঁখির একজন সম্ভাবনাময় শিল্পী। তাঁর ছিপছিপে শরীর ও বাঙময় দৃষ্টি দর্শকের নজর কাড়ে। নাম ভূমিকায় ঋষভ বসু (Rishav Basu) একটু বেশি নাটক করে ফেলেছেন। বস্তির মেয়ে হয়ে দেবলীনা দত্ত (Debleena Dutta) একটু বেশিই দাপট দেখিয়েছেন। তথাগতকে একবার দেখা গেল এক পুলিশের ভূমিকায়, আবার দেবলীনার ‘বাবু’র চরিত্রেও। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে লাগলো।
অবশ্য পুরো ছবিটাই খাপছাড়া, ছিন্নভিন্ন, আদি-অন্তহীন অথচ বোঝা যায় ভিতরে কোথাও গভীর এক বক্তব্য লুকিয়ে রয়েছে। সেটা কোনও বিজ্ঞ দর্শক আবিষ্কার করতে পারলে তাঁকে ধন্যবাদ জানতেই হবে। এমন স্বাধীন প্রচেষ্টাকে দু’হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাতে পারলে খুশিই হতাম। পারছি না, সেটা দুর্ভাগ্য। নানা রঙের কিছু সুন্দর ফুল হাতে থাকলেই যে একটি সুন্দর মালা গাঁথা হবে এটা অবধারিক নয়। মালাটি সুন্দর করে গাঁথার জন্য প্রয়োজন একজন শিল্পী মনের মানুষ ও যথেষ্ট নান্দনিক বোধ ও বুদ্ধির। সেটারই অভাব এই ছবিতে।